বিহারীলাল চক্রবর্তী:
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী ১৮৩৫ সালে ২১ শে মে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসাবে পরিচিত। তাকে রোমান্টিক গীতিকাব্যের স্রষ্টা ও সার্থক পথপ্রদর্শক বলা হয়। তাকে রোমান্টিক ও মিষ্টিক কবিও বলা হয়। সুন্দরের উপাসক বিশ্বের তাবৎ পদার্থের অন্তরালে এক পরম সুন্দরকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার কবিতায় আঙ্গিকগত নতুনত্বের দেখা মেলে। তার কাব্যে ক্লাসিক রীতির ধরন অনেকটা ভিন্ন। যদিও তিনি ক্লাসিক কাব্যরীতি থেকে সম্পূর্ণ বের হতে পারেননি তবুও গভীর ভাবধারার চেতনাকে তিনি নতুনত্বে প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর অনুগামী, রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিকের কবিতায় বিহারীলালের প্রভাব দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে 'ভোরের পাখি' বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন-" সে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কূজিত হইয়া উঠে নাই। সেই উষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল সে তাহার নিজের, ঠিক ইতিহাসের কথা বলিতে পারি না,কিন্তু আমি সেই প্রথম বাংলা কবিতায় কবির নিজের সুর শুনিলাম "
বিহারীলালের রচনাবলী:
সপ্নদর্শন(১৮৫৮), সঙ্গীতশতক(১৮৬২), বঙ্গসুন্দরী(১৮৭০), সারদামঙ্গল(১৮৭৯), নিসর্গসঙ্গীত(১৮৮২),প্রেমপ্রবাহিনী(১৮৭০), মায়াদেবী(১৮৮২),ধূমকেতু(১৮৮২), গোধূলি(১৮৯৯),
গীতিকাব্য ধারা:
গীতিকাব্য ধারা প্রথম প্রকাশ ঘটে মধ্যযুগের বৈষ্ণবকবিতায়। যা পরবর্তীকালে এর নবরূপ প্রকাশ পায় পাঁচালি, কবিগান ও টপ্পা গানের মাধ্যমে। বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলির অন্যতমো কবি। তার অমর উক্তি-
" এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মোহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।"
তাহাড়া টপ্পা গানের অন্যতমো জনক রামনিধি গুপ্ত গীতি কবিতার সূচনাকারী। তার গানের চরণ
" আমি কি কখনো তোমারে
না দেখে থাকিতে পারি,
বিনা দরশনে প্রাণ
শুন্য দেহ শুন্য প্রাণ,
সচেতন হয় পুন:
তব মুখ হেরি।"
বিহারীলাল চক্রবর্তী পরবর্তীতে এই ধারার গানগুলোকে গীতি-কবিতায় রুপ দেন। তার বিভিন্ন কাব্যের স্তবক
" নারীবন্দনা"
(" বঙ্গসুন্দরী"-দ্বিতীয় সর্গ,১৮৭০)
(নির্বাচিত স্তবক)
১২
যেমন মধুর স্নেহ ভরপুর,
নারীর সরল উদার প্রাণ;
দেব-দুলর্ভ সুখ সমধুর,
প্রকৃতি তেমনি করেছে দান।
১৩
পুরুষ, পুরুষ নীরস,
নাহি অধিকারী এ হেন সুখে;
কে দেবে ঢালিয়ে সুধার কলস,
অসুরের ঘোর বিকট মুখ।
১৪
তোমার কুসুম-কানন
কত মনোহর কুসুম তায়;
মরি চারিদিকে ফুটেছে কেমন
কেমন পাবক সুবাস বায়।
" বিষাদ "
("সারদামঙ্গল"-দ্বিতীয় সর্গ,১৮৭৯)
(নির্বাচিত স্তবক)
১০
কোন সুখ নাই মনে,
সব গেছে তার সনে;
খোলো হে অমরগণ স্বর্গের দ্বার!
বল কোন পদ্মবনে
লুকায়েছে সংগোপনে?--
দেখিব কোথায় আছে সারদা আমার!
১২
তেমন অরুন - রেখা
কেন কুহেলিকা ঢাকা
প্রভাত-প্রতিমা আজি কেন গো মলিন?
বল, বল চন্দ্রাননে,
কেন ব্যথা দিয়েছে মনে
কে এমন- কে এমন হৃদয়-বিহীন!
0 Comments